রোহিঙ্গা ইস্যুতে বড় চাপে মিয়ানমার

বিশেষ প্রতিবেদক :

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে প্রথমবারের মতো সর্বসম্মত একটি প্রস্তাব (রেজুলেশন) গ্রহণ করেছে জাতিসংঘ।

স্থানীয় সময় বুধবার জাতিসংঘের তৃতীয় কমিটিতে ‘মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানবাধিকার পরিস্থিতি’ শীর্ষক এই প্রস্তাব গৃহীত হয়। এবারই প্রথম এ সংক্রান্ত প্রস্তাবে কোনো দেশই বিপক্ষে ভোট দেয়নি বা ভোটদানে বিরত থাকার কথা জানায়নি।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ওআইসির পক্ষ থেকে যৌথভাবে উত্থাপন করা এ প্রস্তাবে ১০৭টি দেশ সহ-পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে, যা ২০১৭ সালের পর জাতিসংঘের তৃতীয় কমিটিতে একই বিষয়ে প্রস্তাব গ্রহণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ। জাতিসংঘের তৃতীয় কমিটিতে এর আগেও চারবার একই বিষয়ে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে।

তবে প্রতিবারই প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট পড়েছে এবং একাধিক দেশ ভোট দেওয়া থেকে বিরত থেকেছে। সর্বশেষ ২০২০ সালের ১৮ নভেম্বর গৃহীত প্রস্তাবে ১৩২ দেশ পক্ষে ও ৯টি দেশ বিপক্ষে ভোট দেয়। ৩১ দেশ ভোটদানে বিরত ছিল। কিন্তু এবারের প্রস্তাবে কেউ বিপক্ষে ভোট দেয়নি।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘের উত্থাপিত প্রস্তাবে বারবার বিরোধিতাকারী চীন ও রাশিয়াও এবার এই প্রস্তাবের বিপক্ষে অবস্থান নেয়নি। ফলে ২০১৭ সালের পর এবারই প্রথম রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের ইস্যুতে প্রথমবারের মতো সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাব গৃহীত হলো।

এ খবরে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, প্রথমবারের মতো সর্বসম্মতিক্রমে রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘে প্রস্তাব গ্রহণের বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য দারুণ সুখবর। এর ফলে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়া এবং সংকটের স্থায়ী সমাধানের জন্য মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ বাড়বে। তবে এখনও নিরাপত্তা পরিষদে কোনো প্রস্তাব পাস হয়নি। বাংলাদেশ আশাবাদী যে, ভবিষ্যতে নিরাপত্তা পরিষদেও একইভাবে সর্বসম্মত প্রস্তাব গৃহীত হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সর্বসম্মত প্রস্তাব গ্রহণ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এবং বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক। তবে এখন নিরাপত্তা পরিষদেও একইভাবে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য জোর কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। কারণ নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব গৃহীত না হলে সাধারণ পরিষদে গৃহীত প্রস্তাব মিয়ানমার সরকারের কাছে অতীতের মতোই গুরুত্বহীন বিবেচিত হবে।

এদিকে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এবারের গৃহীত প্রস্তাব ইইউ এবং ওআইসির মধ্যে সহযোগিতার ফল। ইইউ এই যৌথ প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানায়।

সাধারণ পরিষদে সর্বসম্মত এই প্রস্তাব গ্রহণ বিশ্বকে মনে করিয়ে দিতে সাহায্য করবে যে, রোহিঙ্গা এবং মিয়ানমারের অন্য সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।

বিশেষ করে ২০১৬ সালের অক্টোবরের পর সংঘটিত এই অপরাধগুলোর সত্য উন্মোচন এবং জবাবদিহি নিশ্চিত হওয়া জরুরি।

যে সামরিক নেতৃত্ব রোহিঙ্গাদের ওপর মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটিত করেছিল, তাদের নেতৃত্বেই চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি একটি অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। এরপর থেকে জান্তা সরকার সশস্ত্র বহিনীকে অভ্যুত্থান বিরোধীদের ওপর হত্যা, নির্যাতন এবং যৌন সহিংসতা চালানোর নির্দেশ দিয়েছে বলে দৃশ্যমান হয়েছে। ইইউ এ ধরনের অপরাধের কঠোর নিন্দা জানায়।

জাতিসংঘ প্রস্তাবে যা আছে :এবারের প্রস্তাবে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া এবং জাতীয় কভিড-১৯ ভ্যাকসিন কর্মসূচিতে তাদের অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে বাংলাদেশ যে উদারতা ও মানবিকতা দেখিয়েছে, তার ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে। এ ছাড়া কক্সবাজারের অত্যন্ত জনাকীর্ণ ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গাদের একটি অংশকে ভাসানচরে স্থানান্তরের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার যে বিনিয়োগ করেছে, তারও স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে প্রস্তাবে বাংলাদেশ ও জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের মধ্যকার সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরকে স্বাগত জানানো হয়।

প্রস্তাবে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকারের জরুরি অবস্থা জারির প্রেক্ষাপট তুলে ধরা হয়েছে। রোহিঙ্গা সমস্যার মূল কারণ খুঁজে বের করা, বাংলাদেশের সঙ্গে স্বাক্ষরিত দ্বিপক্ষীয় চুক্তির বাধ্যবাধকতাগুলো পূরণ করা এবং মিয়ানমারে নিযুক্ত জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূতসহ সব মানবাধিকার ব্যবস্থাপনাকে পূর্ণ সহযোগিতা দিতে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। চলমান বিচার ও দায়বদ্ধতা নিরূপণ প্রক্রিয়ার ওপর প্রস্তাবটিতে সজাগ দৃষ্টি ধরে রাখার কথাও বলা হয়েছে। প্রস্তাবে মিয়ানমারে নবনিযুক্ত জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূতকে স্বাগত জানানো হয়েছে।

প্রস্তাটি গ্রহণের সময় উপস্থিত ছিলেন জাতিসংঘে নিযুক্ত
বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাবাব ফাতিমা। তিনি এক বিবৃতিতে বলেন, একটি শক্তিশালী ম্যান্ডেট নিয়ে এবারের প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে, যা রোহিঙ্গাদের মনে নতুন আশার সঞ্চার করবে, যে জন্য তারা পথ চেয়ে বসে আছে। তিনি আরও বলেন, আশা করা যায় এবারের প্রস্তাবটি নিজ ভূমি মিয়ানমারে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণের প্রেরণা হিসেবে কাজ করবে।

যা বললেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী :গতকাল সকালে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস) মিলনায়তনে আলোচনা অনুষ্ঠান শেষে উপস্থিত সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, এই রেজুলেশন পাস হওয়ায় রাজনৈতিক দিক থেকে বড় একটা উপকার পাওয়া যাবে। কারণ এবারই প্রথম সর্বসম্মতভাবে রেজুলেশন গৃহীত হয়েছে।

এর আগে জাতিসংঘে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে কোনো রেজুলেশন পাস করানোর জন্য উঠলেই চীন ও রাশিয়া বিপক্ষে দাঁড়িয়েছে। এবার তারা চুপ ছিল। এটাও বাংলাদেশের জন্য বড় সুখবর। এটা বুঝতে সাহয্য করে যে, চীন ও রাশিয়াও চায় রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধান হোক। রাশিয়ার সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে, চীনও কিছু ইনিশিয়েটিভ নিয়েছে। বাংলাদেশের অনেক দিনের চেষ্টার পর আজকের এ সুখবর পাওয়া সম্ভব হয়েছে। এটা অবশ্যই রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ বাড়াবে।

তিনি আরও বলেন, বিগত সময়ে জাতিসংঘে রোহিঙ্গা ইস্যুতে যে রেজুলেশন পাস হয়, সেখানে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের কোনো বিষয় যুক্ত ছিল না। কিন্তু বাংলাদেশ চেষ্টা চালিয়ে গেছে। জাতিসংঘের বিভিন্ন ফোরামে বাংলাদেশ এ বিষয়ে জোরালো বক্তব্য তুলে ধরেছে। এ কারণে এবারের রেজুলেশনে প্রত্যাবাসনের বিষয়টিও এসেছে। এটাও একটা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা ইস্যুতে এখনও প্রস্তাব পাস করানো সম্ভব হয়নি। কিন্তু সেখানে রেজুলেশন পাস হওয়াটা খুব জরুরি। নিরাপত্তা পরিষদে পাঁচজন স্থায়ী সদস্য একমত না হলে কোনো রেজুলেশন পাস হয় না। বাংলাদেশ আশাবাদী, এবার সেখানেও রেজুলেশন পাস হবে।

বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য :সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ওয়ালিউর রহমান সমকালকে বলেন, প্রথমত, সর্বসম্মতভাবে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টি অত্যন্ত ইতিবাচক। এর মধ্য দিয়ে মিয়ানমার সরকার বুঝতে সক্ষম হবে যে, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের পথ তারা দীর্ঘায়িত করলেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ সংকটের ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়নি। বরং তারা আগের চেয়ে বেশি সক্রিয় ভূমিকায় রয়েছে। এটা অবশ্যই মিয়ানমার সরকারের ওপর একটা বড় চাপ সৃষ্টি করবে। তিনি আরও বলেন, চীন ও রাশিয়া সাধারণ পরিষদের রেজুলেশনের বিপক্ষে ভোট দেয়নি। তারা ভোটদানে বিরত থেকেছে। তবে জাতিসংঘের স্থায়ী পরিষদে রেজুলেশন উঠলে সেখানে যে তারা বিরোধিতা করবে না, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়।

সাবেক রাষ্ট্রদূত ও কূটনৈতিক বিশ্নেষক হুমায়ুন কবীর বলেন, গত পাঁচ বছর ধরে প্রতি বছরই জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে এ ধরনের একটি প্রস্তাব পাস হচ্ছে। এবারও একইভাবে প্রস্তাব পাস হয়েছে। এটা প্রমাণ করে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বাংলাদেশের অবস্থানকে নৈতিকভাবে সমর্থন করে। কিন্তু সাধারণ পরিষদে গৃহীত রেজুলেশন দিয়ে কোনো বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। এ জন্য নিরাপত্তা পরিষদের ওপর নির্ভর করতে হয়। সেখানে রেজুলেশন নেওয়ার ক্ষেত্রে পাঁচটি স্থায়ী সদস্যের ভূমিকা একইরকম নাও থাকতে পারে। ফলে নিরাপত্তা পরিষদে কোনো প্রস্তাব পাস হওয়ার আগে এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ নেই।

সাবেক রাষ্ট্রদূত ও বিআইআইএসএসের সাবেক চেয়ারম্যান মুন্সী ফায়েজ আহমেদ বলেন, জাতিসংঘে এই রেজুলেশন গৃহীত হওয়ার বিষয়টি ইতিবাচক ঘটনা। আগের বছরগুলোতেও এ ধরনের রেজুলেশন পাস হয়েছে, যেখানে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের সমালোচনা করা হয়েছে। তবে অন্যবারের তুলনায় একটা পার্থক্য হচ্ছে, এবার সর্বসম্মতভাবে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে।

যেহেতু এবার সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের কথা বলা হয়েছে, যে কারণে চীন, রাশিয়াও এবার ভোটদানে বিরত ছিল- সেটা বলা যাবে না। এখন দেখতে হবে, নিরাপত্তা পরিষদে কোনো প্রস্তাব পাস করানো যায় কিনা। ঝট করেই একটা রেজুলেশন আনা যাবে না। সবার সঙ্গে কথা বলতে হবে। আরও প্রচেষ্টা চালাতে হবে। নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব পাস করানো না গেলে প্রকৃতপক্ষে মিয়ানমারের জান্তা সরকার সাধারণ পরিষদের এই প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেবে না।